বাজার থেকে মধু কিনার সময় আমরা অনেক সময় দেখি কিছু মধুর ঘনত্ব কিছুটা বেশি আবার কিছু মধুর ঘনত্ব পাতলা হয়। অনেকেরই ধারণা, পাতলা ঘনত্বের মধুটা হয়তো খাঁটি মধু না। কিন্তু আসলেই কি তাই? মধুর ঘনত্ব বেশি বা কম হওয়ার সাথে খাঁটি হওয়ার কি কোন সম্পর্ক আছে?
যদি নাই থাকে তাহলে মধুর ঘনত্ব গাঢ় বা পাতলা হয় কিভাবে? আমরা আমাদের আজকের এই আলোচনায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলবো। আশা করি, যারা ক্রেতা এবং রিসেলার আছে তারা এই পোস্টটি পড়ার পর তাদের অস্পষ্ট ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে,
মধুর ঘনত্ব বেশি বা কম হওয়ার কারণ জানার আগে আমাদের আগে জানতে হবে মধুটা আসে কিভাবে অর্থাৎ মধু তৈরী হয় কিভাবে?
সর্বপ্রথমে মৌমাছি ফুল থেকে তরল সংগ্রহ করে যাকে নেকটার বলে। এরপর সেটাকে তারা তাদের পাকস্থলিতে নিয়ে চাকে জমা করে। ফুল থেকে এই নেকটার সংগ্রহ করে চাকে জমা রাখার পর মধু কিন্তু পাতলাই থাকে। মূলত তরল মধু ঘন করার প্রক্রিয়া মৌমাছির পেট থেকে হয় না। তাহলে মধু ঘন হয় কিভাবে?
সারাদিন জমানো পানির মত ঘনত্বের এই মধু রাতে মৌমাছিরা পাখা দিয়ে বাতাস করে বক্সে একটা উষ্ণতা তৈরী করে। এর মাধ্যমেই সামান্য পরিমাণের এই পাতলা মধুতে জ্বলীয় অংশের পরিমাণ কমতে থাকে। এভাবে প্রায় ১২-১৪ দিন ধরে পরিশ্রমের পর ষড়ভুজাকৃতি এক একটি ঘরে পারফেক্ট ঘনত্বের মধু তৈরী হয়। তখনই ঘর গুলোর মুখ মোমের একটি আস্তরণ দিয়ে আটকে দেয় কারণ মধু হওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ। মৌচাষের পরিভাষায় একে ‘ক্যাপিং’ বলা হয়।
এই সময় যখন কোন মৌচাষী মধু সংগ্রহ করবে তখন তিনি গাঢ় এবং পারফেক্ট মধু পাবেন অর্থাৎ মধুর ঘনত্ব সেই সময় বেশি হবে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা পাতলা কিংবা কম ঘনত্বের মধু কিভাবে পাই?
পাতলা কিংবা কম ঘনত্বের মধু পাওয়ার সাধারণত দুইটা কারণ থাকে;
১. উপরের ওই ক্যাপিং হওয়ার আগেই মধু সংগ্রহ করলে মধু পাতলা থেকে যায়। অর্থাৎ যদি কোন মৌচাষী চাকে মধু রাখার ৩ থেকে ৪ দিন পরই মধু নিয়ে নেয় সেই ক্ষেত্রে মধু পাতলা পাবে। কারণ মধু সংগ্রহের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তিনি সংগ্রহ করেছেন।
২. মৌমাছিদের সাধারণত সকাল ৯টা কিংবা ১০টার দিকে নেকটার সংগ্রহ এক্টিভ ভাবে চলতে থাকে, এসময় মধু ভাঙলে, তৎক্ষনাৎ চাকে রাখা পাতলা মধু চলে আসে। গত দিনের বা নিচের মধু অবশ্যই গাঢ় হবে কিন্তু নতুন মধু রাখার পরপরই চাক ভাঙ্গার কারণে উপরের মধুটার সাথে ৯-১০ টার দিকের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় মিশে পাতলা হয়ে যায়।
উপরের এই দুই কারণের জন্য সাধারণত মধু পাতলা হয়। কিন্তু কেউ যদি ১৪ থেকে ১৫ দিন পর মধু সংগ্রহ করেন, মৌমাছি মোমের প্রলেপ দিয়ে দেওয়ার পর সেই ক্ষেত্রে মধু ঘন পাবেন।
তাহলে বুঝতেই পারছেন মধু পাতলা কিংবা ঘন হওয়া নির্ভর করে মধুটা কখন মৌচাষীরা চাক থেকে সংগ্রহ করছেন তার উপর। আর মধু পাতলা কিংবা ঘন হওয়ার সাথে খাঁটি হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এটি একেবারেই একটি ভ্রান্ত ধারণা কেবল।
তবে দেশ ভেদে মধুর পারফেক্ট বা প্রাকৃতিকভাবে ঘন হওয়ার এই প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন হতে দেখা যায়।আবহাওয়া, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত এবং মাটির আদ্রতার পরিমাণ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে মূলত এ প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে মরু অঞ্চলের ফুলের নেকটার থেকে উৎপন্ন মধু অপেক্ষাকৃত বেশি ঘন হয় কারণ সেখানকার আবহাওয়া এবং মাটিতে ময়েশ্চার অনেক কম, পক্ষান্তরে যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বাতাসে এবং মাটিতে ময়েশ্চার বেশি, সেই অঞ্চলের মধু পাতলা হয়। যেমন চায়না, তাইওয়ান,সুন্দরবনের মধু উপরোক্ত কারণে তুলনা মূলক পাতলা হয়।
এবার আরেকটা ভয়ংকর ব্যাপার শেয়ার করি। বেশি লাভের আশায় অনেক মৌয়াল বা মৌচাষীরা মধুর চাক ২ বা ৩ দিনেও ভেঙে ফেলে। সেই ক্ষেত্রে যা হয়, একেবারে অপুষ্ট ও পাতলা মধু পাওয়া যায়। এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় লিচু ও সুন্দরবনের মধুর ক্ষেত্রে। এমন অপুষ্ট মধুতে মধুর বেশিরভাগ গুণাবলি মিসিং থাকে। একই সাথে ৩-৪ মাসের ভিতরই মধু গন্ধ হয়ে যাওয়া, রং পরিবর্তন হওয়ার মত ব্যাপার ঘটে। একারণে উপমহাদেশে বহুকাল ধরে মধুকে উচ্চ তাপীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলীয় অংশ কমিয়ে ঘন করে ফেলা হয়। যার মাধ্যমে ওই অপুষ্ট মধুর সোনালি ও প্রিমিয়াম লুক চলে আসে।
আর এগুলো শোভা পায় আমাদের দেশ সহ উপমহাদেশের সুপারশপ গুলোতে নামিদামি দেশি-বিদেশি ব্রান্ডের স্টিকারে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রথমত অপুষ্ট মধু ভাঙা এবং দ্বিতীয়ত এই উচ্চমাত্রায় তাপ প্রয়োগের ফলে মধুর সামান্য যে গুণাগুণ থাকে ওই মধুতে সেটাও বিলুপ্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের বিষক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়, যার ভিতর HMF অন্যতম। উপমহাদেশে এমন অসাধু ব্যবসা প্রাকটিসের কারণে আমেরিকা সহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত ২৭ টি দেশ বহু বছর ধরে চায়না, ভারত সহ এশিয়ার বৃহৎ প্রায় সকল কোম্পানির মধু নিষিদ্ধ করেছেন। এবং এ সকল কারণে বিশ্বজুড়ে অনেক মধু বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের মধুকে মধু বলে স্বীকার করতে নারাজ।
Author-
Gazi Sakib Ahmad
Founder at BHAB
Stenographer and Editor-
Tasmiha Zaman
Head of Creative at Maag Honey